হরিশ্চন্দ্র রাজার ঢিবি

হরিশ্চন্দ্র রাজার ঢিবি

ঢিবিতায়েফুর রহমান

কবিগুরুর কবিতার মতো অবস্থা_ দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া। ঢাকার সাভারেই থাকি জন্ম থেকে; কিন্তু ঢিবিটা দেখা হয়নি। জায়গার নামও বেড়ে_রাজাসন। রাজা বুঝি আসন গেড়েছিলেন! রাজাসনের কাছেই মজিদপুর গ্রাম। হরিশ্চন্দ্র রাজার ঢিবি আছে হেথায়। বলা হয়, এটি বয়সে কুমিল্লার শালবন বিহারের চেয়েও বড়। শুক্রবার ফুরসতের দিন রওনা হলাম দুপুরে খেয়ে। সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড থেকে টেম্পো ধরলাম, চলল পুবমুখে। লাগল মিনিট বিশেক। লোকজন একে হিন্দুতীর্থ মনে করলেও আসলে এটি বৌদ্ধদের। এখানে ছিল এক বিহার (বৌদ্ধদের ধর্মীয় পাঠশালা)। বেশ কিছু পুরাকীর্তি পাওয়া গেছে এ স্থল খুঁড়ে। আগের দিনে সাভারের লোকজন হরিশ্চন্দ্রের নামে গীত গাইত_
'বংশাবতী পূর্বতীরে সর্বেশ্বর নগরী,
বৈশে রাজা হরিশ্চন্দ্র জিনি সুরপরি।'
বংশাই নদী এখানে বংশাবতী, পুবমুখের নগরটির নাম আগে ছিল সর্বেশ্বর নগরী। এই সর্বেশ্বর থেকে সম্ভার হয়ে নাকি সাভার হয়েছে। হরিশ্চন্দ্র ছিলেন পাল বংশীয় রাজা। সাভারের ইতিহাসের নায়ক এই হরিশ্চন্দ্র। ৭৫২ খ্রিস্টাব্দে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী গোপাল পুত্র ধর্মপাল পূর্ববঙ্গ জয় করেন। তিনি ছিলেন খুব প্রভাবশালী রাজা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে হরিশ্চন্দ্র পালও তাঁর সঙ্গে পূর্ববঙ্গে আসেন এবং বংশাবতীর তীরে রাজধানী গড়ে তোলেন। রাজাসনে রাজবাড়ি ছিল তাঁর। তবে হরেন্দ্রনাথ ঘোষ নামের এক গবেষক মত প্রকাশ করেছেন, বজ্রাসন বিকৃত হয়ে রাজাসন হয়েছে। বজ্রাসন একটা ধ্যানী মুদ্রার নাম। লোকজন বলার সুবিধার্থে রাজাসন বানিয়ে ফেলেছে। ১৭৬৭ সালের রেনেলের মানচিত্র থেকে সাভারের প্রত্নতাত্তি্বক গুরুত্ব প্রথম জানা যায়। জেমস রেনেল (১৭৪২-১৮৩০) ছিলেন ভূগোলবিদ ও নৌ প্রকৌশলী। তিনি বাংলার নদী অববাহিকা সম্পর্কে অনুসন্ধান চালান।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সূত্র থেকে আরো জানা যায়, ১৯১২ সালে ধীরেন্দ্রনাথ বসু নামে একজন লেখক ঢিবিটির এক জায়গায় খুঁড়ে হরিশ্চন্দ্র পাল নামাঙ্কিত একটি ইটের খণ্ড পান। পরে ১৯১৪ সালে ঢাকা রিভিউ পত্রিকায় খনন কাজের একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। একই বছর সাভার অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হরেন্দ্রনাথ ঘোষ ওই ঢিবিতে প্রত্নতাত্তি্বক অনুসন্ধান চালান। ১৯২১ সালে বাংলাদেশের বিখ্যাত মুদ্রাতাত্তি্বক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর উদ্যোগে এখানে সীমিত আকারে খননকাজ চলে।
এরপর অনেক দিন সব থেমে ছিল। ১৯৮৮-৮৯ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে ঢিবিতে খননকাজ চালায়। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খননকাজ চালিয়ে গেছে পরেও। ফলে এখানে বৌদ্ধ বিহার, স্তূপ, ব্রোঞ্জের বৌদ্ধ মূর্তি ও টেরাকোটা মূর্তি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে লোকেশ্বর-বিষ্ণু মূর্তিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া বৌদ্ধ বজ্রযান মতবাদের ধ্যানীবুদ্ধ অমিতাভের বোধিস্বত্ব 'পদ্মপাণি' মূর্তিও পাওয়া গেছে। এ ছাড়া দুটি অবলোকিতেশ্বর বোধিস্বত্ব লোকনাথ, অভয় মুদ্রার ধ্যানীবুদ্ধ, প্রজ্ঞাপারমিতা ও দুটি পাদমঞ্চ পাওয়া গেছে। এগুলো এখন ঢাকা জাদুঘরে আছে। গবেষকরা মনে করেন, এগুলো খ্রিস্টীয় নবম-দশম শতকের শিল্পরীতির বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। আরো ধারণা করেন, বৌদ্ধ ধর্মবিরোধী কোনো বহিঃশত্রুর আক্রমণে ধর্মকেন্দ্রটি পরিত্যক্ত হয়। সম্ভবত একাদশ শতকে। বাড়ি থেকে এই ইতিহাস পড়ে এসেছি। পড়াসঙ্গী করে হাঁটা ধরি। এখানে বসতি তৈরি হয়েছিল দুই ধাপে। দ্বিতীয় ধাপের বসতিকে মাটির ওপরে উঠিয়ে আনা গেছে, প্রথমটি এখনো ভেতরে। আন্দাজে বুঝি, মাটি থেকে তিন ধাপ উঁচুতে ছিল গৃহমঞ্চ। মূল বিহার গৃহের সম্মুখভাগে হয়তো স্মৃতিস্তম্ভ ছিল কয়েকটি, ছাত্রদের থাকার ঘর, উপাসনা ঘরও সম্ভবত ছিল। গ্রন্থাগার থাকাও বিচিত্র নয়। প্রতিটি ইট ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। ইতিহাস বুঝি লেগে যায় হাতে! খর রোদে এসে ঢুকেছি, বিকেলের লাল আলোয় মনটা আরো দূরে চলে যায়। যেন দেখতে পাই_গেরুয়াধারী ছোট ছোট ন্যাড়া মাথার ভিক্ষুরা মাগন থেকে ফিরছে, ধ্যানী কোনো ভিক্ষু জপমালা গুনছেন দূরদিগন্তে চেয়ে। ঘণ্টায় আওয়াজ ওঠে, ছোট ছোট আলো জ্বলে ওঠে বিহারের ঘরগুলোয়।

কিভাবে যাবেন
ঢাকার গুলিস্তান থেকে হানিফ, সুপার বাস, বোরাক, বিআরটিসি, ডি-লিংক (গুলিস্তান-ধামরাই), শুভযাত্রাসহ আরো কিছু পরিবহনের বাসে চড়ে সাভার বাসস্ট্যান্ডে নামা যায়। ভাড়া ৩০ থেকে ৫০ টাকা। এরপর রিকশায়, ভাড়া
১৫ টাকা।

 

সূত্রঃ দৈনিক কালের কন্ঠ ২৭/১১/২০১১ ইং