শিমগ্রাম মথুরাকান্দি

শিমগ্রাম মথুরাকান্দি

বিছানা ছাড়লাম তাড়াতাড়িই। সুনামগঞ্জ সদর থেকে মথুরাকান্দি বেশি দূরে নয়, তবে ঘোরপ্যাঁচ আছে। নাশতা সেরে রিকশায় যাই সাহেববাড়ি ঘাট। নৌকায় সুরমা নদী পার হলে পাই অলিরবাজার। মোটরসাইকেলের ড্রাইভার রফিক রেডি ছিল, পেছনে উঠে বসতেই ভোঁ চালিয়ে দিল। সঙ্গে আছেন সেলিম ভাই। শীত আসি আসি করছে, বাতাসে হিমেল গন্ধ। রাস্তা উঁচু-নিচু, মেঘালয় পাহাড়ের নিচ দিয়ে জায়গা করে নিয়েছে। মথুরাকান্দির আক্তাপাড়া পর্যন্ত যেতে সময় লাগল আধঘণ্টা। চোখ ভরে গেল শিমের সবুজে আর তার বেগুনিরঙা ফুলে। প্রথম দেখাতেই যাকে বলে ফিদা হয়ে গেলাম।
কচি শিমগাছে দুলছে শীত-দুপরের মিষ্টি উত্তুরে হাওয়া। হঠাৎ সবুজ ফুঁড়ে দুটি মাথা উঠল। খেয়ালই করিনি এতক্ষণ, দুই গৃহবধূ ক্ষেতে কাজ করছেন। কথাও বলছেন টুকটাক_সংসারের, বাজারের বা পুকুরঘাটের। ধানচাষের উপযোগী নয় এসব জমি। মথুরাকান্দির কৃষক-কিষানিরা তাই বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছেন শিমকে। নিজেদের বীজ থেকেই প্রায় তিন দশক ধরে এখানে তাঁরা শিমের আবাদ করছেন। কমবেশি ৫০০ পরিবার লেগেছে এ কাজে। গ্রামটায় কেমন যেন সুখ সুখ হাওয়া!
কিছুক্ষণ বাদে রফিক সাইকেল ছোটাল বিস্তীর্ণ ক্ষেতের আলপথ ধরে। বাঘবের ও আক্তাপাড়া গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে গিয়ে থামল। আচ্ছামতো ছবি তুললাম। এরপর হাঁটা দিলাম_ইচ্ছা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখব। সবুজে হাত রেখে হাঁটার আনন্দ অনাবিল। হাঁটতে হাঁটতে সেই দুই কিষানির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। শিম তুলে টুকরিতে ভরছেন। আলাপ করে জানলাম, স্থানীয় বাজারে এখন শিমের দর কেজিপ্রতি ৬০-৮০ টাকা। এবার ফলন হয়েছে জব্বর, দুই গুণ লাভ হবে। আরো জানালেন, শিমচাষ সোজা নয়। ফসল আসার পর থেকে প্রতিদিনই কীটনাশক ছিটাতে হয়।
সবুজ ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমরা চালবন্দ, মাঝেরটেক, জিনারপুর, রামপুর, ঘরেরগাঁও ঘুরে ফেললাম। স্থানীয়ভাবে এই শিম প্রজাতিকে 'পলাইশ্যা' এবং 'জিনারপুরী' নামে ডাকা হয়। প্রথমে পলাশ ও জিনারপুর গ্রামে চাষ শুরু হয় বলে এই নামকরণ হয়েছে। ক্ষেত চষে পরে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে একবার ঢুঁ মারলাম। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা এ টি এম শফিকুল ইসলাম জানান, চলতি অর্থবছরে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় পাঁচ শতাধিক চাষি এক হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে শিমচাষ করেছেন। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ হাইব্রিড, বাকি ৬০ শতাংশ দেশীয়। মাটি দোআঁশ বলে ধানের চেয়ে শিম ভালো হয়।
সূর্য মাথার ওপর উঠলে ফেরার পথ ধরলাম। মাঝপথে পেলাম জাহান রেস্টুরেন্ট। ছোট চিংড়ি মাছ এবং তাজা ছোট শিং মাছ দিয়ে ভালোই উদরপূর্তি হলো। তিনজনের সাকল্যে খরচ হলো ১৬০ টাকা। পথেই পড়ল ইক্ষু ও গুড়ের গ্রাম আদাঙ। দৃষ্টির শেষ সীমাতক শুধু আখক্ষেত। মাঝেমধ্যে অস্থায়ী মাড়াই ঘর। মেশিনে আখ মাড়িয়ে রস নিংড়ে নেওয়ার পর জ্বাল দেওয়া হয়। বেশ সময় নিয়ে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি হয়। এখানকার গুড় সারা সুনামগঞ্জে মশহুর। আদাঙ গ্রামটি সীমান্তনদী চলতির পশ্চিম পাড়ে। শুক্রবার চলতি নদীটি হাজার হাজার বারকি শ্রমিকের কাছ থেকে জিরান নেয়। ছুটি পেয়ে ওই দিন নদীটি সাজগোজ করে। তার বাঁকে বাঁকে উপচে পড়ে আনন্দ।
গুড়চাষি রফিকুল ইসলাম জানান, মার্চ-এপ্রিলে আখের চারা রোপণ করা হয়। কাটা হয় নভেম্বর-ডিসেম্বরে। বছরে একবারই চাষ হয়। প্রতি ৩০ শতাংশ জমিতে চাষবাবদ খরচ হয় আট থেকে ৯ হাজার টাকা। রফিকুলের পীড়াপীড়িতে আখের রস খেতে হলো। তারপর আবার সাইকেলে উঠলাম। পথে এক জায়গায় রফিক কদু (লাউ) বাগান দেখাল। অলিরবাজারে আসতে দেখি সূর্য ডুবতে বসেছে। তবে সুরমায় লালগালিচা বিছাতে ভোলেনি।
কিভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে মামুন, শ্যামলীসহ আরো কিছু পরিবহনের বাসে সুনামগঞ্জ যাওয়া যায়। ভাড়া ৪৫০ টাকা। সুনামগঞ্জ শহর থেকে রিকশা নিয়ে সাহেববাড়ি ঘাট। নদী পার হলে অলিরবাজার। তারপর মোটরবাইকে যেতে হয় মথুরাকান্দি ও আদাঙ গ্রামে।

 

সূত্র: দৈনিক কালের কন্ঠ, ২০/১১/২০১১ ইং