পাথরপুরী টেকেরঘাট

পাথরপুরী টেকেরঘাট

নেত্রকোনা হয়ে গেলে খানিক বেগ পেতে হবে। তবে সুবিধাও আছে। উত্তরে গারো পাহাড়ের সারি, দক্ষিণে টাঙ্গুয়ার হাওর পড়বে পথে পথে। শেষ দিকে গারো পাহাড় ছাড়িয়ে ওয়েস্ট খাসি হিলেরও বেশ খানিকটা পাতে পড়বে। এ রাস্তায় মোটরসাইকেল ছাড়া অন্য কিছু চলে না, খরচও কম নয়। আর সুনামগঞ্জ হয়ে গেলেও পাহাড় পাওয়া যাবে, বাড়তি মিলবে জাদুকাটা নদী। এই নদীটা মেঘালয়ের তিন পাহাড়ের গহ্বর থেকে বেরিয়ে এসে টাঙ্গুয়ার হাওরে গিয়ে পড়েছে। পানি টলটলে। অজস্র পাথর তোলা নৌকা এর গায়ে চরে বেড়ায় সকাল থেকে সন্ধ্যা। বাতাস বয় মনে রাখার মতো। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থানার মধ্যে পড়েছে টেকেরঘাট।
এদিকটায় গেলে রাজাই গ্রামের রাজার বাড়িতে থাকি। রাজা ছিলেন খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোক। টেকেরঘাট চুনাপাথর প্রকল্পের প্রকৌশলী ছিলেন। রাজাই থেকে প্রকল্প কার্যালয় সাত কিলোমিটার দূরে। রাজা মাথায় হ্যাট পরে ঘোড়ায় চড়ে অফিসে যেতেন। মারা গেছেন ১৯৮৮ সালে। এখন তাঁর ছেলে এন্ড্রু সলোমার রাজত্ব দেখাশোনা করেন। বাড়িটা মেঘালয় পাহাড়ের ঠিক নিচে। বড় বাড়িতে গাছপালা অনেক, পুকুর আছে দুটি, একটা চার বিছানার বৈঠকখানাও আছে। মেহমান গেলে এন্ড্রুদা জাল ফেলেন পুকুরে। তেলাপিয়া-খলসের সঙ্গে রুই মাছও ধরেন। বাড়িতে চালতা ও কামরাঙাগাছ আছে। দুপুরে ঝাল মাখিয়ে আপ্যায়ন করেন। হেমন্তের রাজাই ধানে সয়লাব। পথের দুই পাশে দোল খায় সোনালি সবুজ। পড়ন্ত বিকেলে এন্ড্রুদার মোটরসাইকেলের পেছনে বসে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে প্রথমে গেলাম চানপুর বাজারে। বাজারটা ছোট, পাশেই বিডিআর ক্যাম্প। এরপর গেলাম বড়ছড়া। স্থলবন্দর এটি। ভারত থেকে এ বন্দর দিয়ে শুধু কয়লা আসে। টাঙ্গুয়ার হাওরের কাছে বড় জায়গাজুড়ে কয়লাপুরী। ধরমপাশা, কলমাকান্দা, নান্দাইল থেকে আসা শ্রমিকরা এখানে কাজ করে। কালোর বিরাট আখড়া এটা। বন্দরের সমতলভাগ আমাদের দখলে, আর পাহাড় যেখান থেকে উঠেছে তা ভারতের।
টেকেরঘাট পেঁৗছাতে বিকেল নেমে এল। ছোট ছোট টিলার সারি প্রবেশমুখে। টিলাগুলো বানানো। এন্ড্রুদা বললেন, 'কোয়ারি থেকে চুনাপাথর তুলতে যে মাটি সরাতে হয়েছে তা দিয়ে তৈরি হয়েছে এসব টিলা।' টিলা পেরিয়ে একটা পুকুরের কাছে চলে এলাম। এটি একসময় ছিল পাথরের পাহাড়। পাথর সরাতে সরাতে পুকুরটি তৈরি হয়েছে। পাহাড়টি বাংলাদেশ-ভারত উভয়ের ভাগেই পড়েছিল। ভারতের পাহাড়টি এখনো বর্তমান, পুকুরটার গা ঘেঁষে। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে গুটিকয় হলুদ ভবন। কোনোটা কার্যালয়, কোনোটা বিশ্রামাগার। পুকুর ধরে কিছুদূর এগোনোর পরই রেললাইনের দুই ধারে দুটি বৃহদাকার ক্রেন। রেললাইন দিয়ে ট্রলিতে করে পাথর বয়ে নেওয়া হতো ভাঙানোর কারখানায়। ভাঙানো হলে নৌকায় তুলে হাওর হয়ে এসব পাথর যেত ছাতক সিমেন্ট কারখানায়। আরো কিছুদূর এগোলে একটা বড় মাঠ ও টেকেরঘাট বিদ্যালয়। এর পেছনেই ছিল চুনাপাথর প্রকল্পের কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের কলোনি। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে লাখমা খাল। খালটি এসেছে অল্প দূরের মেঘালয়ের পাহাড় ফুঁড়ে। প্রকল্পের উত্তর প্রান্তে একটা কবরস্থান আছে। একাত্তরে এখানে বড় যুদ্ধ হয়েছিল, সেই যুদ্ধের শহীদরা শায়িত আছেন এখানে। প্রকল্প এলাকার শেষ মাথায় একটা ছোট্ট রেলস্টেশনও আছে। চুনাপাথর প্রকল্পটি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ। পাষাণ বুকে চেপে নিথর হয়ে পড়ে আছে পাথরনগরী টেকেরঘাট। উত্তুরে হাওয়ায় সন্ধ্যাটা হিমেল হয়ে এলে আমরা লাখমা খালের পাড়ে গিয়ে বসি। চুপচাপ স্থির চারধার, শব্দ যা সব বাতাসের। ওপরে পাহাড়ের গায়ের রাস্তা দিয়ে একটা-দুটো গাড়ি যায়, বোধ হয় শিলংয়ে। অনেক দূরে পাহাড়ের ডগায় দু-একটা আলো জ্বলে। সব কিছু এত চুপচাপ যে প্রাণ আনচান করে।

কিভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে শ্যামলী, মিতালিসহ আরো কিছু পরিবহনের বাস সুনামগঞ্জে যায়। ভাড়া ৪৫০ টাকা। শহরের সাববাড়ি (হাছন রাজার বাড়ি) ঘাট থেকে গুদারা পার হয়ে মণিপুরি হাটে যেতে হবে। সেখান থেকে মোটরসাইকেলে যাওয়া যায় টেকেরঘাট। সময় লাগে দুই ঘণ্টা। ভাড়া জনপ্রতি ১৫০ টাকা।

 

সূত্র: দৈনিক কালের কন্ঠ, ১৯/১১/২০১১ ইং