রুপালি নারিকেল জিনজিরা

রুপালি নারিকেল জিনজিরা

রাশেদুল মজিদ

নারিকেলগাছ অনেক দ্বীপটিতে। প্রবালপ্রাচীরে ঘেরা। পানি ঝকঝকে পরিষ্কার। ১০ থেকে ১৫ ফুট নিচের জীবন্ত প্রবাল, সামুদ্রিক মাছও স্পষ্ট দেখা যায় গগলসের ভেতর দিয়ে। তাই তো সেন্টমার্টিনকে অনেকে ন্যাচারাল অ্যাকুয়ারিয়াম বলে। নারিকেলগাছের কারণে আগে লোকজন একে ডাকত নারিকেল জিনজিরা। আমরা তিন বন্ধু গিয়েছিলাম। কঙ্বাজার থেকে শাহপরী দ্বীপ যাওয়া-আসার ট্যুরিস্ট বাস মিলল। সিটপ্রতি ভাড়া ৩৫০ টাকা। নাফ নদী পাড়ি দেওয়ার জন্য এলসিটি কুতুবদিয়া জাহাজের টিকিটও কেটে নিই আগাম। কঙ্বাজারে জাহাজ কর্তৃপক্ষের অফিস আছে। ভাড়া জনপ্রতি ৭০০ টাকা। আগের রাত উত্তেজনায় পার হলো। ভোর সাড়ে ৬টায় বাসে উঠে গেলাম। কনকনে ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার দশা। পৌনে ৭টায় রওনা দিল বাসটি। পৌনে ১০টায়ই শাহপরী দ্বীপ জেটিতে পেঁৗছে গেলাম। কুয়াশা না থাকলে হয়তো আড়াই ঘণ্টাই কাফি ছিল।
গাড়ি থেকে নেমে দীর্ঘ জেটি পাড়ি দিয়ে জাহাজে উঠি। সোয়া ১০টায় জাহাজ ছাড়ল। যাত্রীসংখ্যা চার-পাঁচ শর কম হবে না। জাহাজটি যখন নাফ নদী পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের মোহনা পাড়ি দিচ্ছিল, তখন বুকে কাঁপন ধরেছিল। বিরাট বিরাট ঢেউ পারলে গায়ে এসে পড়ে। পুব দিকে মিয়ানমারের পাহাড়গুলো সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। দুরবিন দিয়ে বৌদ্ধ প্যাগোডা, নাসাকা বাহিনীর ক্যাম্প দেখা যায়। আমাদের কপাল ভালো, সাগরের স্বচ্ছ পানিতে শুশুকের নাচও দেখতে পেলাম।
ঘড়ির কাঁটা যখন ১১টা ছোঁয়, তখন মাছের লেজের মতো কিছু একটা ঠাহর করা যাচ্ছিল। জাহাজ আরো কাছে গেলে সেন্টমার্টিনও এগিয়ে এল। সাড়ে ১১টায় জেটিতে ভিড়ে গেলাম। কে কার আগে নামবে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। প্রবাল ছড়ানো দ্বীপজুড়ে। প্রাসাদ প্যারাডাইস হোটেলে থাকার জায়গা খুঁজতে গেলাম। কক্ষ ভাড়া দুই হাজার টাকা। তিনজন এক ঘরেই থাকব। দুপুর ২টায় জেটির কাছের এক হোটেলে রূপচাঁদা মাছ দিয়ে দুপুরের খাবার সারলাম।
বিকেলে ১০০ টাকায় একটি ভ্যান ভাড়া করে পশ্চিম সৈকতের দিকে রওনা হলাম। হুমায়ূন আহমদের কটেজ সমুদ্রবিলাসের দেখা পেয়ে গেলাম। ভ্যান বিদায় করে হাঁটা ধরলাম। ইচ্ছা উত্তর দিক দিয়ে জেটিতে পেঁৗছাব। সূর্যটা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিল। লাল হয়ে উঠছিল ক্রমেই। পানির সঙ্গে খেলা জমিয়েছিল মজার। আবীর ঢেলে ঢেলে অস্থির করে তুলছিল আমাদের। চোখে হীরার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছিল। সন্ধ্যা নামলে চরাচরে শান্তির বাতাস বইছিল ঢের। আমরা নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। কী এক ঘোর বিছিয়ে পড়েছিল মনে!
সে রাতে জ্যোস্নাও ঝরেছিল। চাঁদ উঠেছিল নারিকেলগাছের মাথায়। দ্বীপের বালু চকচক করে উঠেছিল। এটি যেন চাঁদের দেশ! রাতে সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন গিয়েছিলাম ছেঁড়াদ্বীপে।

যাওয়া, খাওয়া, থাকা
রিজার্ভ মাইক্রোবাসে কঙ্বাজার থেকে শাহপরীর দ্বীপ জেটিতে যাওয়া-আসার ভাড়া সাত হাজার টাকা। আর ট্যুরিস্ট বাসে কঙ্বাজার শহরের কলাতলী থেকে শাহপরীর দ্বীপ জেটিতে আসা-যাওয়া প্রতিজন ৩৫০ টাকা। এসব গাড়ি সকালে নিয়ে যাবে এবং সন্ধ্যায় কঙ্বাজারে নিয়ে আসবে। সেন্টমার্টিনে এক দিন থাকতে চাইলেও গাড়িগুলো আপনাকে পরের দিন শাহপরীর দ্বীপ জেটি থেকে ঠিকই কঙ্বাজারে নিয়ে যাবে। সেন্টমার্টিন যাওয়ার আগের দিনই আপনাকে শাহপরী দ্বীপ থেকে সেন্টমার্টিন চলাচলকারী যেকোনো একটি জাহাজের সিট বুকিং দিতে হবে। বর্তমানে ওই পথে কেয়ারি সিন্দাবাদ, ঈগল, এলসিটি কুতুবদিয়া, ফারহানসহ ছয়টি জাহাজ চলাচল করছে। কঙ্বাজার শহরের কলাতলীতে এসব জাহাজের বুকিং কাউন্টার রয়েছে।
শাহপরী দ্বীপ জেটি ঘাটে গিয়েও আপনি টিকিট নিতে পারেন। তবে মৌসুমে খুব ভিড় হয় বলে আগের দিন টিকিট নিয়ে রাখা ভালো। ভোর সাড়ে ৬টার মধ্যে কঙ্বাজার থেকে ট্যুরিস্ট বাসে চড়তে হয়। সকাল ১০টায় শাহপরী দ্বীপ পেঁৗছে উঠতে হবে জাহাজে। সেন্টমার্টিন পেঁৗছবে সকাল সাড়ে ১১টায়। সেন্টমার্টিন থেকে জাহাজ আবার ফিরে আসবে বিকেল ৩টায়। আর বিকেল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার মধ্যে জাহাজ ফের ভিড়বে শাহপরীর দ্বীপ জেটিতে। সেখানে আপনাকে ফেরত নেওয়ার গাড়ি অপেক্ষা করবে। ওই গাড়িতে চড়ে রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যেই পেঁৗছে যাবেন কঙ্বাজার। সেন্টমার্টিন থেকে ছেঁড়াদিয়া দ্বীপে যেতে রিজার্ভ স্পিডবোটে ভাড়া নেবে দুই হাজার টাকা। আর কাঠের বোট রিজার্ভ ভাড়া নেবে দুই হাজার ৫০০ টাকা। কাঠের বোটে ওঠা যাবে ২০ জন।
থাকার জন্য অনেক কটেজ ও রিসোর্ট আছে সেন্টমার্টিনে।
কক্ষপ্রতি ভাড়া ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা। সেন্টমার্টিনে গিয়ে ডাব পাবেন প্রতিটি ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। জেটির ধারের রেস্তোরাঁগুলোয় রূপচাঁদা ফ্রাই, ডাল, আলুভর্তা, সবজি ও ভাত খেতে পারবেন প্রতি প্লেট ২৫০ টাকায়। এ ছাড়া সামুদ্রিক অন্যান্য যেকোনো মাছ ফ্রাই, ডাল, আলুভর্তা, সবজি ও ভাত খাওয়া যাবে জনপ্রতি ১০০, ১৫০ ও ১৮০ টাকার তিনটি ভিন্ন ভিন্ন দামে। ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমে কঙ্বাজার থেকে সেন্টমার্টিন আসা-যাওয়ার এক দিনের প্যাকেজ প্রতিজন ১৫০০, ১৮০০, ২০০০ ও ২৫০০ টাকা। এসব প্যাকেজের মধ্যে গাড়িভাড়া, জাহাজের
টিকিট ও খাবার অন্তর্ভুক্ত।

 

সূত্রঃ দৈনিক কালের কণ্ঠ ০১/০১/২০১২ ইং