কুদুম গুহা

কুদুম গুহা

এম আহসানুল হক খোকন

গুহা দেখার সাধ তৈরি হয় সেই ছোটবেলার সমাজবিজ্ঞান বই থেকে। মানুষ একসময় গুহাবাসী ছিল, বন্য প্রাণীর ভয়ে তটস্থ থাকত, আকাশে বিজলি চমকালে চমকে উঠত। বেশি লোক আমাদের দেশে গুহা দেখার সাধ পূরণ করে না। আমাদের বেশির ভাগের চেনা গুহা হলো খাগড়াছড়ির আলুটিলা। গুহার মধ্যে মাঝারি মানের হলো বান্দরবানের আলীকদমের আলীর গুহা আর বগালেক পাড়ার ওপরে আলেকঅং। আমার কাছে দেশের সেরা গুহার নাম কুদুম। কঙ্বাজার জেলার টেকনাফ থানায় গুহাটি। পড়েছে টেকনাফ গেম রিজার্ভ নামের একটি বনের ভেতর। বনটিও সে রকম_হাতি আছে। তবে বাঘ, ভালুক এখন আর নেই। আমাদের পাহাড়গুলো শিলা পাথরে তৈরি নয় বলে গুহা তৈরি হয় না। আর যেগুলো আছে সব জানিও না। আমাদের পার্বত্য এলাকায় ভূতাত্তি্বক, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও পর্যটন বিষয়ে জরিপ বেশি হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র, রোমাঞ্চপ্রিয় পর্যটক আর শৌখিন বন্য প্রাণী-পাখি পর্যবেক্ষণ দলগুলো কয়েকটি খুঁজে বের করেছে। আমারও বন্য প্রাণী, বিশেষ করে পাখি দেখার বাতিক আছে।
কুদুম গুহা গঠন, আকৃতি-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যে স্বতন্ত্র। গেছিও বারবার। ব্যাপকহারে বন উজাড় করার কারণে কুদুমও পড়েছে বিপাকে। কঙ্বাজার-টেকনাফ মহাসড়কে প্রায় ৫০ কিলোমিটার গেলে পাওয়া যায় হোয়াইক্যং বাজার। বাজারের পশ্চিম দিকের রাস্তা ধরে শামলাপুর যাওয়া যায়। পাহাড়ি উঁচু-নিচু আর আঁকাবাঁকা পথে প্রায় আট কিলোমিটার পর বাঁ দিকে আছে হরিখোলা। চাকমা জনগোষ্ঠীর বসত এখানে। হরিখোলা থেকেও দুই কিলোমিটার দূরে কুদুম গুহা। কুদুম যাওয়ার রাস্তার প্রায় সবটাই লতা-গুল্মে ঘেরা। পথও কর্দমাক্ত, ঝিরিপথ। ঘণ্টাখানেক লেগে যায় হরিখোলা থেকে। কুদুম কিন্তু মাটির তৈরি। প্রবেশমুখ জমি থেকে প্রায় ১০-১২ ফুট উঁচু। মুখটা প্রায় চার ফুট চওড়া। গুহার ভেতরের দেয়াল ছত্রাকে ভেজা ভেজা। ঢুকেই পাওয়া যায় হাঁটুপানি, ভেতর দিকে প্রায় কোমরসমান। ফাটল চুইয়ে পানি পড়তে থাকে সব সময়। বর্ষাকালে পানি থাকে বেশি, শীতকালে হাঁটু অবধি। গুহার ফাঁকফোকরে প্রচুর চামচিকা। অল্পদিন হয় ড. রেজা খান বাংলাদেশের উড়ুক্কু স্তন্যপায়ী প্রাণীর তালিকায় নতুন প্রজাতির চামচিকা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আমি শেষবার কুদুম গিয়েছিলাম ড. মনিরুল এইচ খানের সঙ্গে। তিনি সেবার দুই প্রজাতির চামচিকার ছবি তুলতে পেরেছিলেন। গুহার পানিতে দেখেছিলাম চ্যাং মাছ (টাকি মাছ), কৈ, কাকিলা, তিনচোখা, ডানকিনে এবং কালো রঙের চিংড়ি। চ্যাং মাছগুলো আকারে বেশ বড়, ওজন হবে প্রায় ৩০০ গ্রাম। এরা পানি থেকে ওপরে প্রাচীরে ঝুলে ছিল। অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পানিতে আরো দেখেছি কয়েক রকমের ব্যাঙ, গুগলি আর শামুক।
আমাদের হাতে থাকে টর্চ, মাথায়ও লাইট বাঁধা। আলো জ্বাললেই অন্য রকম দৃশ্য তৈরি হয়_শত-সহস্র চামচিকা উড়তে থাকে আর ভয় পেয়ে বিষ্ঠা ও প্রস্রাব বর্ষণ করতে থাকে। পানিতে থাকা মাছ তা খেতে প্রতিযোগিতা শুরু করে। গুহার গায়ে কয়েক প্রজাতির মাকড়সা, উড়চুঙ্গা, গুবরেপোকা আর পিঁপড়া দেখেছি। গুহার ধারে বাস করতে দেখেছি এক জোড়া নীলশিষদামা। বিকেল গড়িয়ে এলে এদের দেখা মেলে সহজে। এখন আছে কি না জানি না। দুপুরে একটা এশীয় নীলপরীকে গুহার পুবের সিবেটগাছে মিষ্টি সুরে ডাকতে দেখেছিলাম। আরো দেখেছি পাকড়াধনেশ, ময়না, বড়মেটে কাঠকুড়ালি ইত্যাদি। গুহার ভেতরের দেয়ালে কেউ একজন লিখে গেছে 'লিপি+সোহাগ'। হেসে বাঁচি না! স্পেনের আলতামিরার গুহাচিত্রের কথা মনে পড়ল। হেসে ফেললেও ভয় ধরল, পর্যটকরা একটু হুঁশে না থাকলে তো চামচিকাদের কষ্টই বাড়বে, মাছগুলোও প্রাণ হারাবে।

কিভাবে যাবেন
ঢাকার ফকিরাপুল থেকে শ্যামলী, এস আলম বা সৌদিয়া পরিবহনের বাসে টেকনাফ যাওয়া যায়। ভাড়া ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। তারপর মাইক্রোবাস ভাড়া নেওয়া যেতে পারে সারা দিনের জন্য। ভাড়া পড়বে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা। আর কঙ্বাজার থেকে টেকনাফগামী ডাইরেক্ট বাসে হোয়াইক্যং বাজার নামা যায়। ভাড়া ৮০ টাকা। হোয়াইক্যং বাজার থেকে কুদুম গুহা যেতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করা যায়।

কোথায় থাকবেন
হ্নীলা বাজার হোয়াইক্যং বাজারের কাছেই। সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। ভাড়া ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এ ছাড়া টেকনাফ শহরে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল আছে। ভাড়া ৫০০ থেকে এক হাজার ২৫০ টাকা। টেকনাফে সাধারণ মানের হোটেলও আছে, ভাড়া ২৫০ থেকে শুরু হয়।

গাইড
টেকনাফ গেমরিজার্ভ ভ্রমণের সময় প্রশিক্ষিত গাইড সঙ্গে নেওয়া জরুরি। হোয়াইক্যং বাজারের কাছে আইপ্যাক এবং নিসর্গের কার্যালয় থেকে গাইড নেওয়া যায়।
ছবি : সৈয়দ জাকির হোসেন

 

সূত্রঃ দৈনিক কালের কণ্ঠ ১১/১২/২০১১ ইং